প্রস্তাবিত বৈষম্য বিরোধী আইন-২০২২ আইনটি একটি সম্ভাবনা। তবে যথাযথ বাস্তবায়নই বড় শঙ্কা থাকবে। আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্যে দৃশ্যমান রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা, দক্ষ প্রশাসন ও নাগরিক নজরদারি প্রয়োজন। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাকে কার্যকর করতে হবে।
রোববার (১০ এপ্রিল) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে অনুষ্ঠিত ‘প্রস্তাবিত বৈষম্য বিরোধী আইন ২০২২ : নাগরিক প্ল্যাটফর্মের প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বিভিন্ন বক্তাদের বক্তব্যে এসব উঠে আসে।
জাতীয় সংসদে বৈষম্য বিরোধী বিল-২০২২ গত ৫ এপ্রিল উত্থাপন করা হয়েছে। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহুদিন ধরেই এমন একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছে। বৈষম্য বিরোধী যে বিল সংসদে উত্থাপিত হয়েছে তা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য নাগরিক প্ল্যাটফর্মের এমন আয়োজন ছিল।
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তার বক্তব্যে বলেন, বহুদিন ধরেই নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো এ আইন উত্থাপন ও খসড়া প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা করে আসছে। ২০১৭ সালে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সম্মেলনের একটি ঘোষণাপত্রেও এই আইন উত্থাপনের দাবি করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে, সংবিধানের মৌলিক ধারাগুলোর উপর ভিত্তি করেই এই আইনটি উত্থাপন করা হয়েছে। তবে, এই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্যে দৃশ্যমান রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা, দক্ষ প্রশাসন ও নাগরিক নজরদারি প্রয়োজন।
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বৈষম্য মানে ক্ষমতার অসমতা। যারা বৈষম্যের স্বীকার হন তারা ক্ষমতাহীন। পৃথিবীর সব দেশেই বৈষম্য রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহারে করেই বৈষম্য করা হয়। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে আইন থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নেই বললেই চলে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। বৈষম্য বিরোধী আইনকে একটি সম্ভাবনা হিসেবে দেখছি। কিন্তু বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করি। সংজ্ঞাগুলো অসম্পূর্ণ। বৈষম্যের কাঠামোগত সংজ্ঞায়নে মানসিক প্রতিবন্ধী, বর্ণ বৈষম্য ও এসিডদগ্ধদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আইনে বিভিন্ন কমিটির কথা বলা হয়েছে। তবে কমিটির কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত বলা নেই।
তিনি বলেন, বৈষম্যমূলক আইনে কিছু ভাষাগত বিষয় বাদ পড়েছে। গায়ের রং, এসিড আক্রান্তদের এই আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আদিবাসী নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। মনিটরিং কমিটির প্রধান কেন মন্ত্রী হবেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, রাজনৈতিক শূন্যতার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার ব্যপ্তি ঘটানোর জন্যেই সব ধরনের আইন প্রণীত হয়। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিভিন্ন আইনে প্রতিকারের মনিটরিং কমিটি গঠিত হলেও, তাদের কোনো ধরনের সভা অনুষ্ঠিত হয় না। ফলে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন দেখা যায় না।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর (যেমন- হিজড়া, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু) সদস্যরা তাদের বিরুদ্ধে হওয়া বৈষম্যের ব্যাপারে জানিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে একটি আইনের মাধ্যমে সব ধরনের বৈষম্যকে কেন্দ্রীভূত করার এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে, আইনে বৈষম্যের সংজ্ঞায় এখনো কিছু সমস্যা আছে। যেমন– যৌনকর্মীদের পেশা বৈধ কি-না; এ ব্যাপারে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। বৈষম্যের প্রতিকার কীভাবে হবে সেটা এই আইনে স্পষ্ট নয়। তাছাড়া, রাষ্ট্রের অনেক আইনেই বৈষম্যমূলক ধারা আছে। যেমন – সাক্ষ্য আইনের মাধ্যমে ধর্ষিতার চরিত্র হনন, একজন নারীর কাজী না হতে পারা কিংবা প্রতিবন্ধীদের বিসিএস বা জুডিশিয়াল সার্ভিসে সক্রিয়ভাবে যোগদানের সীমাবদ্ধতা।
সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস সিনিয়র ফেলো ড. ফস্টিনা পেরেইরা বলেন, প্রতিকারের জায়গাটা আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত। যেমন – একজন ব্যক্তি একের অধিক ধরনের বৈষম্যের সম্মুখীন হতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি কী ধরনের প্রতিকার পাবেন, সেটা স্পষ্ট নয়। তাছাড়া, উত্থাপিত আইনে অভিযোগ দায়ের থেকে শুরু করে সবশেষে প্রতিকার পেতে একধরনের প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রিতা লক্ষণীয়।
নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী প্রধান জাকির হোসেন বলেন, ঢাকায় বসে প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে কী ধরনের বৈষম্য চর্চা হয়, সেটা বোঝা খুব কঠিন। উত্থাপিত আইনে সুস্পষ্টভাবে কোনো শাস্তির বিধান রাখা হয় নেই। এ ক্ষেত্রে আইনে সুস্পষ্ট শাস্তির বিধান থাকা জরুরি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও সভা প্রধান শাহীন আনাম সভাপতির বক্তব্যে আইন উত্থাপনের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, এ আইন উত্থাপন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম রয়েছে। ২০০৭ সালে প্রথম এর কাজ শুরু হয়। তখন লক্ষ্য করা হয়, বৈষম্যকে সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্য করে কোনো আইন নেই। পরবর্তীতে জনমত জরিপের মাধ্যমে ২০১৩ সালে আইন কমিশনে খসড়া জমা দেওয়া হয়। এখন এই আইনটি জনগণের প্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে সেজন্যে সঠিক মনিটরিং কমিটি প্রয়োজন।
সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী সব ধরনের বৈষম্য নিরোধে এমন আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত ৫ এপ্রিল ‘বৈষম্য বিরোধী বিল-২০২২’ সংসদে তোলেন। পরে সেটি ৩০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।