ঝুঁকিতে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর হাফিজুর রহমান নামের এক নির্মাণ শ্রমিক নির্মাণাধীন একাডেমিক ভবন থেকে পরে গুরুতর আহত হন, পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ছাত্রদের জন্য নির্মাণাধীন ১০ তলা হলের উপর থেকে মারা যান নুর আলম নামের আরেক নির্মাণশ্রমিক।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বহুতল ভবন নির্মাণে যেসব সেফটি কোড আছে তার অধিকাংশই মানছে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে করে প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্মাণাধীন বিল্ডিং নেট দিয়ে ঢেকে দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ বিল্ডিংয়েই নেটের ব্যবহার করা হচ্ছেনা। নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের চারপাশে সেফটি ফাস্ট লেখার বাউন্ডারি থাকলেও সেই বাউন্ডারি নেই। সাটারিং করার সময় খুঁটিগুলো মেটালের হওয়ার কথা থাকলেও অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাঁশের উপর হলুদ রঙ করে সেগুলোকে মেটাল হিসেবে চালিয়ে দিতে দেখা গেছে।
সাটারিং খোলার সময় বাউন্ডারি লাইন দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি করছেনা বেশির ভাগ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও সাটারিং খোলার পুরা জায়গাটুকু টিন দিয়ে ঢেকে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছেননা অনেকেই। এতে করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, পথচারী, নির্মাণশ্রমিকদের যেকোন সময় বিপদ ঘটতে পারে।
গেলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, পুরো বিল্ডিং নেট দিয়ে ঢেকে দেওয়ার কথা যাতে করে উপর থেকে কোন কিছু পড়লে নেটে আটকে যেতে পারে কিন্তু এখানে অধিকাংশ বিল্ডিংয়ের মধ্যেই সেটা নেই। আমরা শিক্ষার্থীরা যখন করি তখন ছোট একটা ইটের টুকরাও গায়ে পড়লে আমাদের যেকোন বিপদ ঘটতে পারে।
এছাড়াও কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্মাণসামগ্রী যেখানে সেখানে রেখে কাজ করতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের হাঁটার জায়গার মধ্যেই রড এবং অন্যান্য নির্মাণসামগ্রি রাখতে দেখা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী জানান, শিক্ষার্থীরা যেখান দিয়ে চলাচল করেন সেখানেই রড রেখে দেওয়া হয়েছে। এই রডগুলোর মুখে প্লাস্টিকের ক্যাপ থাকার কথা থাকলেও সেটা নাই। হাঁটার সময় যেকোন একটা দুর্ঘটনা ঘটলে এই দায়ভার কে নিবে!।
বুধবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চলমান প্রকল্পে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শ্রমিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছে। কাজ করার সময় শ্রমিকদের মাথায় হেলমেট, পায়ে গাম বুট, কোমরে সেফটি লাইন ব্যবহার করে কাজ করতে দেখা যায়নি। রাতে কাজ করার সময় ফ্লোরসেন্টযুক্ত সেফটি জ্যাকেট থাকার কথা থাকলেও সেগুলো দেখা যায়নি।
তবে প্রকল্পের সাথে জড়িত অনেকেই বলছেন, এই ধরনের ঘটনাগুলো অনেক আগে থেকেই ঘটে আসছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকল্প পরিচালকের দপ্তরের সহযোগিতায় এই ঘটনাগুলোকে চাপা দিয়ে আসছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপের ভয়ে কাউকে নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলো নিয়ে কেউ কথা বলছেন না।
নিহত নূর আলমের নির্মাণাধীন ভবনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান হোসাইন কনষ্ট্রাক্টশনের সত্ত্বাধিকারী উজ্জ্বল হোসাইন বলেন, সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দুর্ঘটনাবসত পড়ে গিয়ে মারা গেছে। কাজের জন্য সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
এইসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (অবসরপ্রাপ্ত) জি এম আজিজুর রহমান বলেন, আমরা আমাদের জায়গা থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলো মেনে চলার জন্য সবসময় বলেছি। প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর থেকে অনেকবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পথচারী এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো মেনে চলার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা ওদেরকে লিখিত এবং মৌখিক দুইভাবেই বলেছি। কিন্তু ওরা কয়েকদিন নিরাপত্তার বিষয়গুলো মানে এরপর আবার বিষয়গুলোতে মানে না। যার কারণে কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে।
তবে বারবার চিঠি দেওয়ার পর নির্দেশ অমান্য করা কারণে কেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি সেই বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক কোন উত্তর দিতে পারেননি।
এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হাফিজা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শ্রমিকদের মৃত্যু দুঃখজনক। নিরাপত্তার আরেকটু শক্ত হওয়ার দরকার ছিল- এটাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেইসব বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের আমরা নির্দেশনা দিয়েছে। যদিও ঠিকাদারদের দেখার কথা। কিন্তু সেটা ঠিক মতো হয়তো হচ্ছে না। কাজের নিরাপত্তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অ্যাম্বুলেন্সসহ যতটুকু ব্যবস্থা করে দেয়ার দরকার সেটা দিয়েছি। আর ভবিষ্যতে যাতে শ্রমিকদের মৃত্যুর কোনও ঘটনা না ঘটে সেই ব্যবস্থা নিতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছি।’