পেঁয়াজের রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাবনার সুজানগরের পেঁয়াজ চাষিরা শেষ সময়েও দাম না পেয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আমদানিকৃত পেঁয়াজের জন্য দেশি পেঁয়াজের বাজারে ধস নেমেছে। মৌসুমের শেষ দিকেও নিজেদের ঘরে রাখা সংরক্ষিত হালি পেঁয়াজের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না এই অঞ্চলের প্রান্থিক চাষিরা। ফলে দেশি পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আবাদ হয় সুজানগরে। এজন্য সুজানগরকে পেঁয়াজের রাজধানীও বলে। চলতি মৌসুমের পেঁয়াজ আবাদকে সামনে রেখে উপজেলার অধিকাংশ হাট-বাজারগুলোতে এখন দেশি পেঁয়াজের কেনাবেচা ধুম লেগেছে।
সুজানগরের পৌর হাট, কাশিনাথপুর হাট, আতাইকুলা হাট, দুবলিয়া হাট, বনগ্রাম হাটসহ উপজেলার অন্তত ১০-১৫টি হাটে পেঁয়াজ বিক্রি হয়। এসব হাটে প্রতিদিন শতশত টন পেঁয়াজ বিক্রি হয়। হাটগুলোতে প্রাইকারি দরে প্রতি মণ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে সাড়ে ১২০০ টাকা করে। কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে। কেনাবেচা চললেও দাম নিয়ে হতাশ প্রকাশ করেছেন চাষিরা, এতে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন তারা।
কৃষকরা জানান, বর্তমান বাজারে এক কেজি পেঁয়াজের দানার (বীজ) দাম ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে চাষিদের। আর সেই দানা নিয়ে পেঁয়াজ চাষ করতে শ্রমিক, কীটনাশক, সার দিয়ে বিঘা প্রতি ফলনে ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে তাদের।
তাদের দাবি, বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির কারণে দেশি পেঁয়াজের দাম কমে যাচ্ছে। যখন পেঁয়াজ সংকট চলে তখন পেঁয়াজ আমদানি কম থাকে, কিন্তু যখন আমাদের দেশি পেঁয়াজ কেনাবেচা শুরু হয় ঠিক তখনই এলসি খুলে দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। দেশে সব কিছুর মূল্য বৃদ্ধি পেলেও পেঁয়াজের দাম প্রতিদিনিই কমছে। সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত না থাকায় এই ক্ষতিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। আর এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে নতুন মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করবে। তাই দেশের পেঁয়াজ চাষিদের বাঁচাতে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি এলসি বন্ধের দাবি জানান স্থানীয় কৃষকরা।
সুজানগরের দুর্গাপুরের চাঁদ আলী মন্ডল বলেন, গত মৌসুমে আমি ২৫ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছিলাম। আবহাওয়া ভালো থাকায় ফলনও ভালো হয়েছিলো। কিন্তু বাজারে বিক্রির সময় আশানুরুপ দাম পাইনি। এজন্য বাড়ির চাতালে অধিকাংশ জমির পেঁয়াজ রেখে দিয়েছিলাম শেষ সময়ে অধিক দাম পাবো বলে। চলতি সময়ে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা দর পেঁয়াজের বাজার থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে এই বাজার ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২শ টাকা করে। গতবার পেঁয়াজ চাষ করে পুরোটাই ক্ষতির মধে পড়েছি। ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় আগামী মৌসুমের জন্য ২৫ বিঘা থেকে কমিয়ে ১৫ বিঘার মতো পেঁয়াজ চাষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এরপরও সার-বিষের যে দাম হয়েছে চাষাবাদ বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে। দ্রব্যমূল্যের যে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে সেই অনুযায়ী পেঁয়াজের দাম নেই বললেই চলে।
সুজানগর পৌর হাটে কথা হয় কৃষিতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সুজানগরের ভায়না গ্রামের মোহাম্মদ কামরুজ্জামান প্রামাণিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত বছর পেঁয়াজ আবাদ করেছি প্রায় ২০ বিঘা জমিতে। শুরুতে দামে আশাহত থাকলেও পরে নিরাশ হইনি। এক বিঘা জমিতে কীটনাশক খরচ ৩ হাজার টাকা, সার ও চাষ বাবদ ৫ হাজার টাকা। শ্রমিক খরচ ১৫ হাজার টাকা। আর জমি ইজারা নিতে হয় ২০ হাজার টাকা দিয়ে। সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি ৪০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়েছিলো। কিন্তু ৩০ হাজার টাকা করেও উঠাতে পারিনি।
সুজানগর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের পেঁয়াজের মৌসুমে শুধু সুজানগর উপজেলাতে ১৯ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে মূলকাটা পেঁয়াজের আবাদ হয়েছিল। উপজেলায় মোট পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিকটন। এই উৎপাদিত পেঁয়াজের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ কৃষকদের কাছে মজুদ রয়েছে।
পাবনার সুজানগর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. রাফিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাটি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় পাবনার এই অঞ্চলে পেঁয়াজের ফলন বেশ ভালো হয়ে থাকে। দেশের মানুষের দেশি পেঁয়াজের অনেকাংশেই এই জেলা ও উপজেলার পেঁয়াজ চাহিদা পূরণ করে আসেছ। তবে পেঁয়াজের বাজার উঠানামা করছে মৌসুমের প্রথম দিক থেকেই। আগে যেখানে ২০ থেকে ২৫ মণ পেঁয়াজ পেতো বিঘা প্রতি, সেখানে একই জমিতে বর্তমানে কৃষক প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ মন পেঁয়াজ পাচ্ছে। তাই দাম খুব একটা কমেনি।
তিনি বলেন, লাভের বিষয়টি আসলে বলা মুশকিল। তবে পেঁয়াজের বীজের দাম কৃষি সামগ্রির দাম বৃদ্ধি হওয়ার কারণে হয়তো লাভটা কম হচ্ছে। আর এলসির বিষয়টি আসলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়, কৃষি বিভাগের এখানে খুব একটা করণীয় নেই। তবুও আমরা কৃষকদের জন্য আমাদের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি। আশা করছি কৃষকরা পেঁয়াজের সঠিক মূল্য পাবেন।